বিশেষ সংবাদদাতা :
পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ায় ওই রুটের ২৯ টি ফেরি থেকে কয়েকটি ফেরি কুতুবদিয়া – মগনামা নৌ-রুটে চলাচলের দাবি দেড় লক্ষ দ্বীপবাসীর। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবেই প্রতিদিন নদী পার হচ্ছেন হাজার হাজার দ্বীপবাসী। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কুতুবদিয়া ঘাট পারাপারের কারণে ফেরি চালুর আকুতি অবহেলিত জনগোষ্ঠীর।
কুতুবদিয়া দ্বীপটিতে দেড় লাখ মানুষের বসতি। কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন তারা। বিপদসংকুল পরিস্থিতিতেও লক্কর ঝক্কর নৌকা, ট্রলারে করে নদী পার হতে হয় দ্বীপবাসীদের। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও এই নৌপথে ফেরি সার্ভিস চালু না হওয়ায় আক্ষেপ রয়েছে তাদের।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভবিষ্যতে চালুর জন্য ১৯টি নতুন ফেরি রুট চিহ্নিত করা হলেও কুতুবদিয়া চ্যানেলের নাম না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কুতুবদিয়ার অবহেলিত জনসাধারণ।
মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ নৌকা, ট্রলার ও স্পিডবোটে করে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার বড়ঘোপ থেকে চকরিয়া মগনামা ঘাট পারাপার করছেন। বিশেষ করে ৩ কিলোমিটারের এই নৌ পথটিতে মালামাল নিয়ে পারাপার হওয়া যেমন কষ্টের তেমনি বাড়ছে খরচও। এমনকি মুমূর্ষ রোগীরা উন্নত চিকিৎসার জন্য নদী পার হতে গিয়ে মারাও যান। তাই এই ঘাটে ফেরি সার্ভিস চালুর দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
বর্তমানে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌ রুটে আটটি এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে ২১টি ফেরি চলাচল করছে। এই দুই রুটে মোট ফেরি আছে ২৯টি। পদ্মা সেতু চালুর পর ওই পথে চলাচলরত ফেরি ও লঞ্চের কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সেতু চালুর পর মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ও শরীয়তপুরের কাঁঠালবাড়ির মধ্যে ফেরি ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
ভবিষ্যতে চালুর জন্য ১৯টি নতুন ফেরি রুট চিহ্নিত করা হয়েছে। আবার বর্তমানে চালু রুটেও ফেরির সংখ্যা বাড়ানো হবে। প্রস্তাবিত রুটের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ থেকে গাইবান্ধার বালাসী ঘাট, মানিকগঞ্জের আরিচা থেকে পাবনার নরাদহ, পিরোজপুরের বেকুটিয়া থেকে চরখালী, কক্সবাজার থেকে মহেশখালী, বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ থেকে হিজলা এবং বরগুনা থেকে আমতলী।
এছাড়া ইজারাদারদের সিন্ডিকেট সাধারণ মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। মগনামা-কুতুবদিয়া ঘাট পারপারে টুলসহ নিয়ম মোতাবেক ২০ টাকা বোট ভাড়ার মধ্যে ইজারাদাররা নেয় ৪০ টাকা। স্পিডবোটে করে ৭০ টাকার জায়গায় তারা নিচ্ছে ১২০ টাকা। ফলে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয় দ্বীপবাসিদের। যদিও ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পরে ইজারাদারদের বিরুদ্ধে জনভোগান্তি লাঘবে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসুচির কারণে ভাড়া কিছুটা কমিয়ে দু’পাশের দুই জেটিতে ৫ টাকা করে মোট ১০ টাকাসহ ঘাট পারাপারে বোট ভাড়া ৩০ টাকা এবং স্পিডবোট ভাড়া ৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
চারদিকে সমুদ্রে ঘেরা এ উপজেলার উৎপাদিত পণ্য দ্রুত পরিবহনের অভাবে প্রতিবছর আর্থিকসহ বিবিধ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে কৃষকরা। চট্টগ্রাম, চকরিয়া ও কক্সবাজার থেকে পণ্য পরিবহনের জন্য বড়ঘোপ-মগনামা নৌ রুটের নদীতে ফেরি সার্ভিস চালুর দাবি এলাকার বিভিন্ন পেশার মানুষের। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দুর্বল ও অযোগ্য নেতৃত্বের কারণে খেসারত দিতে হচ্ছে তাদের। যুগের পর যুগ ধরে এই নৌপথে ফেরি চালুর দাবি জানানো হলেও তাদের কথার কোনো মূল্যায়ন হয়নি।
কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আকবর খান বলেন, ‘ফেরি সার্ভিস চালু হলে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে অতি সহজেই এখানে আসা সম্ভব হবে। এতে করে এলাকার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও বাড়বে। ফেরি চলাচল শুরু হলে ভারী যানবাহন অতিসহজে কুতুবদিয়ার গ্রামেগঞ্জে ঢুকতে পারবে।’
কক্সবাজার কুতুবদিয়া সমিতি, কুতুবদিয়া উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি হুমায়ুন সিকদার বলেন, ‘সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি দ্বীপবাসী। ফেরি সার্ভিস চালু অনেক দিনের দাবি এখানকার বাসিন্দাদের। কার কথা কে শোনে! ফেরি চালু হলে নিত্যপণ্য আনা-নেওয়ার চাহিদা পূরণ হবে। মানুষের খরচও কমবে। কিন্তু সিন্ডিকেট চক্র উন্নয়ন চায় না। তাদের এমন জঘন্য কার্যক্রমে কষ্ট পাচ্ছে কুতুবদিয়ার হাজার মানুষ। ঘাট ইজারাদারদের কালো ইশারায় ফেরি সার্ভিস চালু করা হচ্ছে না।’
দ্বীপের আলী আকবর ডেইলের বাসিন্দা ইস্কান্দার মির্জা বলেন, ‘বন্যা তাড়িতদের কপাল যেন আজীবন পোড়া। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার হয়ে গেল কিন্তু এখনো ফেরি চালু হয়নি। দ্বীপের নেতাদের কোনো যোগ্যতা নাই। ফেরি সার্ভিস চালুর বিষয়ে কোনো নেতাকে মাথা ঘামাতে দেখিনা আমরা।’
শিক্ষার্থী সাকিব বলেন, ‘কক্সবাজার জেলায় কুতুবদিয়া শিক্ষায় সবচেয়ে উন্নত উপজেলা। এখানকার শতশত শিক্ষার্থীকে নদী পাড়ি দিয়ে কক্সবাজার শহরে স্কুল, কলেজ মাদরাসায় যেতে হয়। জন্মের পর থেকে শুনে আসছি ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে আমাদের নদী পার হতে হবে না। কিন্তু এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি। ঝুঁকিপূর্ণ ট্রলারে অতিরিক্ত যাত্রীদের সঙ্গে আমাদের নদী পার হতে হয়। এছাড়া নৌকার লোকরা ভাড়াও অতিরিক্ত রাখে। সবমিলিয়ে এক দুঃখময় জীবন পার করছে কুতুবদিয়াবাসী।’
দ্বীপের সচেতন মহল জানান, ‘দেশের বিভিন্ন উপকুলীয় জেলায় স্রোত সহনীয় ফেরি চালু রয়েছে। দৌলতদিয়া, পাটুরিয়া, শিমুলিয়া, আরিচা, বাংলাবাজার, গোয়ালন্দ, মাওয়া ঘাটে ফেরি সংযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন চলাচলে অনেক গতি এনে দিয়েছে। কেবল কক্সবাজারের কুতুবদিয়া এখনো ফেরি বঞ্চিাত একটি জনপদ।’
জানা যায়, কুতুবদিয়ার বাসিন্দা, সাবেক সচিব ও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের প্রচেষ্টায় ২০০৮ সালে সী ট্রাক চালু হলেও কয়েকমাস পর তা অদৃশ্য কারণে বন্ধ হয়ে যায়। এতে স্থানীয় কিছু কুচক্রী মহল ও ঘাট ইজারাদারদের ইন্ধন রয়েছে বলে মনে করে অনেকে। যত দ্রুত সম্ভব ফেরি সার্ভিস চালুর দাবি কুতুবদিয়া দ্বীপবাসীর।