আলী ওসমান শেফায়েত
মায়ের উদর থেকে জন্মগ্রহণ করা শিশুটি ধর্ষক হয়ে আসেনি। সে ছিল নিষ্পাপ-মাসুম। কিন্তু প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পরই এ নিষ্পাপ শিশুদের কেউ পরিণত হয় খুনী ও ধর্ষকে। কেন? তার বেড়ে উঠা ঠিকভাবে হয়নি। বাবা-মা তাকে সুশিক্ষা দিতে পারেননি। হ্যা, ধর্ষকের বাবা-মা তাকে খাবার দিয়েছে, কাপড় দিয়েছে, ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যার পর টিভির পর্দায় সে দেখছে-
‘সিনেমা-নাটকের নায়করা নায়িকাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলতে টিজ করছে। তার হাত টেনে বুকের সাথে ঠেসে ধরে বলছে, “প্রিয়া! এই বুকে শুধু তোমারই বসবাস। তোমাকে ছাড়া এ বুক শূন্য।” এসব বলে বলে নায়িকার পিছনে ঘুরঘুর করতে থাকে। মজার ব্যাপার হলো- এক সময় নায়িকা পটে যায়। নায়কের প্রেমে হাবুডুবু খায়। তার জন্য পরিবার, সমাজ, সম্মান–সব বিসর্জন দিয়ে ভালোবাসার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।’
সিনেমা-নাটকে ধর্ষণের রগরগে দৃশ্য, ধর্ষিতার চিৎকার শুনে ধর্ষকের মজা পাবার হাহা-হোহো করার দৃশ্য ছাড়া সিনেমার পুর্ণতা নেই যেন। সিনেমায় স্বাধীন নারীর ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য স্বল্প পোশাক দেখাতে হয়। তাকে নাচতে হয় নিজের বিভিন্ন অঙ্গের বৈচিত্রময় প্রদর্শনী করে। এমন কি স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোও! কেন? –এটা পুরুষ দর্শকের চোখের চাহিদা।
সৃষ্টিগতভাবে নারী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ রয়েছে। এ আকর্ষণের চাহিদা কিছুটা হলেও সিনেমা নাটকে পূরণ হচ্ছে। ফিল্ম মেকার চায়, তারা যেন এসব ‘বিউটিফুল’ দৃশ্য দেখে। এভাবেই তাদের চাহিদা বাড়বে। শরীর দেখিয়ে পুরুষ দর্শকের মন জয় করবে। নারীকে কিভাবে সিনেমায় আকৃষ্ট করবে? –নারীর ভালোবাসার জন্য কিভাবে একজন পুরুষ লড়াই করে, এটা দেখে নিশ্চিত সে প্রশান্তি পায়। নারী হিসেবে ‘স্পেশাল’ ফিল করে। আবেগী গল্পের মায়ায় পড়ে নিজেকে দামী মনে করে। সে অনুভব করে না, ওদিকে একজন নারীর স্বল্প বসনের মাধ্যমে পুরুষদের আকৃষ্ট করা হচ্ছে। এখানে নারী হয়ে উঠছে পণ্য। আর এদিকে তাকে ধর্ষণ করার প্রাথমিক পাঠ নিচ্ছে তারই পাড়ার, গ্রামের, মহল্লার ছেলেটা!
নায়ক যেভাবে নারীকে টিজ করে, তাকে জোর করে টেনে বুকে ঠেকায়, পিছু নেয়, সর্বদা ডিস্টার্ব করতে থাকে- এসবের অবশ্যই মনস্ত্বাত্তিক প্রভাব রয়েছে। পুরুষ শিক্ষা পাচ্ছে, নারীর ভালোবাসা প্রাপ্তির এটা ‘হিরোয়িক পদ্ধতি’। নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার ‘প্রাথমিক শিক্ষা’ এখানে।
মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের বৈধ ও স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতির প্রতিষ্ঠা করা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার দায়িত্ব। শারীরিক চাহিদাকে মূল্যায়ন করে ‘বৈধ যৌনতা’ অবলম্বন নিশ্চিত করা। আমার জ্ঞানমতে বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মের সবকটিতে বৈধ যৌনতার মাধ্যম হলো ‘বিয়ে’। কিন্তু সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাস্তবতা বিলম্ব বিয়েকে উৎসাহিত করে। আজকাল বিয়ে করতে করতে ২৪-৩০ বছর লেগে যায়। অথচ তার মধ্যে যৌনতার স্বাভাবিক তাড়না সৃষ্টি হয় ১৫ বছর থেকে। তার মানে, ১০-১২ বছর সে নিজের এ চাহিদাকে দমিয়ে রাখতে বাধ্য হয়। নতুন গড়ে উঠা আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় তাকে স্বাভাবিক একটা চাহিদা মেটাতে ১০ বছর অপেক্ষা করতে হয়। এই ১০ বছর সে কিভাবে পার করে? হস্তমৈথুন, বিবাহ বহির্ভূত যৌনতা এবং ধর্ষণের মাধ্যমে।
ধর্ষণ কিভাবে বিয়ে দেরিতে হওয়ার সাথে সম্পর্কিত? দেখুন, সিনেমা-নাটকে একজন ছেলে ধর্ষণের প্রাথমিক শিক্ষা ইতিমধ্যেই নিয়েছে। ইন্টারনেটের সুবাদে পর্নগ্রাফিতে সে এ শিক্ষাকে পুর্ণতায় রূপ দিচ্ছে। আবার রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থায় নেই যথেষ্ট আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা। একইসাথে বৈধভাবে যৌনতার মত স্বাভাবিক চাহিদা মেটানো তার জন্য কঠিন করে দেওয়া হয়েছে। এখন এই ছেলেটা কেমন? সে এখন ধর্ষণ করার মতো বোধহীন জন্তুতে পরিণত। যাকে আমরা সহজে বলতে পারি ‘পটেনশিয়াল রেইপিস্ট’!
এই ‘পটেনশিয়াল রেইপিস্ট’ এবার সেক্যুলার পরিবেশে পড়ালেখা করে। রাস্তায়, ক্লাবে, ক্লাসে, খেলার মাঠে সে নারীকে খোলামেলা পোশাকে দেখে। বান্ধবীদের সাথে মিশে। যদি সে কারো সাথে শারীরিক সম্পর্ক গড়ার মতো যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ হয় তবে সেখানেই তার লালসা চরিতার্থ করে। যেহেতু সমাজ এমন অবৈধ সম্পর্ক প্রশ্রয় দেয় না, সে অনেক সময় এতে ব্যর্থ হয়। ঘুরে বেড়ায় একজন ‘পটেনশিয়াল রেইপিস্ট’ হয়ে। আর শারীরিক সম্পর্কে যেতে ব্যর্থ ছেলেটা তার সফল বন্ধুর থেকে শুনে, কিভাবে সে তার গার্লফ্রেন্ডকে ‘খেয়ে যাচ্ছে’। নারী দেহের রগরগে বর্ণনা শুনে সে লালায়িত হয়। পরিণত হয় ‘পাগলা কুত্তা’য়। সে আরো বড় মাপের ‘পটেনশিয়াল রেইপিস্ট’ হয়ে ঘুরে বেড়ায়।
সে এখন ধর্ষণের জন্য সুযোগ ও পরিবেশের অপেক্ষায়। একাকী নারী, ক্লাসমেট, বান্ধবীকে সে সুযোগ ও পরিবেশমত পেলে ধর্ষণ করে বসবে। পরের দিন পত্রিকার পাতায় খবর ছাপাবে- “ধর্ষণের পর সহপাঠীকে হত্যা”। ছাত্র-শিক্ষকসহ সকল শ্রেণিপেশার মানুষ প্রতিবাদ করবে। মিছিল-মিটিং, মানববন্ধন চলবে। যৌন উস্কানিমূলক উপন্যাস, গল্প,কবিতা রচয়িতা কবি-লেখকরাও পত্রিকায় কলাম লিখবে। সিনেমায় অশ্লীল নৃত্য করা সেই নায়ক-নায়িকা, গায়িকারাও প্রতিবাদ করবে। দুনিয়াপুজারি, আধ্যাত্মিকতাশুন্য সেক্যুলাররা অনেক অনেক বাণী ছাড়বে। সেগুলোর অন্তর্নিহিত বার্তা হলো, “ধর্ষক তৈরী হবে এমন সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ ও রাষ্ট্র চাই। নির্বিঘ্নে ধর্ষণ করা যাবে এমন পরিবেশ চাই”। এ বার্তা তারা সজ্ঞানে-অজ্ঞানে প্রচার করে বেড়াবে তাদের কথা ও লিখনীর আড়ালে। তাদের অন্তরে মোহর মারা থাকায় তাদের নিজেদের কথা ও লিখনীর অন্তর্নিহিত নিকৃষ্টতম তাৎপর্যও তারা বুঝবে না। সেলিব্রেটি পুজারি, মিডিয়ার ধাঁধায় আসক্ত সাধারণ মানুষ তো আরো বুঝবে না।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক