কুতুবদিয়া সাগরের মাঝখানে স্পিড বোটে জন্ম নেওয়া শিশুর বিষয়ে মানবিক ডাক্তার সৈকত বড়ুয়া মুন্না তার নিজস্ব ফেসবুক আইডি থেকে এক আবেগঘন স্টাটাস দেন তিনি।
উক্ত ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেন, “আমার ডাক্তারি জীবন সর্বসাকুল্যে বছর ছয়েক। স্মৃতির খেরোখাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ করে রাখার মতো আরেকটি ঘটনা আজকে জীবন আমাকে উপহার দিলো।
বড়ঘোপ জেটি ঘাট। কুতুবদিয়া দ্বীপবাসীর বলতে গেলে খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে বেঁচে থাকার প্রায় সকল রসদ নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে বড় বড় কাঠের বোট এসে ভীড়ে এই ঘাটে। পণ্য খালাস চলে প্রতিদিন সকাল থেকে শুরু করে বিকাল পর্যন্ত। সাথে মানুষের ব্যস্ত পারাপার তো আছেই। দাপ্তরিক কাজ শেষে মহেশখালী ফিরবো। সাথে ছিলেন জেলার সহকারী পরিচালক মহোদয় এবং আরেকজন সহকর্মী। নিত্যদিনের ভীড় ঠেলে স্পীডবোটে উঠলাম। কুতুবদিয়া চ্যানেল পাড়ি দিবো। বড়ঘোপ ঘাটের অদূরেই (এক কিলোমিটারের ভেতর) কুতুবদিয়া চ্যানেল মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। আকাশে এই প্রখর রোদ, এই থমথমে কালো মেঘ। কখনো পাগলা হাওয়ার নাচন নিয়ে ঝড়, কখনো-বা ঝেঁপে বৃষ্টি। আর বজ্রের হুংকার তো আছেই। এর মধ্যে হুট করে থাবা বসায় কালবৈশাখী। এ মৌসুমের আবহাওয়াটা এমনই। তবে আজ আকাশ ছিলো পরিষ্কার। বিকেলের মিষ্টি রোদ আর পশ্চিমা শুষ্ক ঠান্ডা বাতাসে মার্চ-এপ্রিলের চিরচেনা ভয়ংকর সমুদ্র বলতে গেলে আজ মোটামুটি শান্তই ছিলো।”
তিনি আরো বলেন, “সমুদ্রপাড়ের ছেলে হওয়াতে এখানকার সমস্তকিছুর সাথেই আমি মিশে থাকি। যাই হোক ঘটনায় ফিরি—বোট চলছে… এরকম একটি বোটে সাধারণত ৮-১০ জন পারাপার হয়। আমাদের বোটে মানুষ ছিলো ৭ জনের মতো। আমি আর সহকারী পরিচালক মহোদয় সামনে দুটো সিটে বসলাম। যাত্রী কম নেয়ার কারণ হলো একজন রোগী ও তার আত্মীয়স্বজন আছেন বোটে। এখানে রোগী আনা নেওয়ার ব্যবস্থা দেখলে যে কারোর-ই বুকে ভালোই জোর থাকতে হবে। কিন্তু এখানকার জন্য নিত্যদিনের ঘটনা। যাই হোক মগনামা ঘাটের কাছাকাছি এসেছি। হঠাৎ ছোট বাচ্চার কান্নার শব্দ আর কিছুটা চেঁচামেচি শুনতে পাই, পিছনে ফিরে দেখি লংকাকান্ড। রোগী (মা) চেহারা এক্সস্টেড, আধশোয়া অবস্থায় পিছনে একজনের কোলে হেলান দিয়ে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছেন, ঘামছেন।আরেকজন নীচে বসে কাথা মুড়ি দিয়ে বাচ্চা বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। শুরুতে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। পরে সহকারী পরিচালক মহোদয় সাহস দিলেন। পরিচয় দিলাম ডাক্তার। যে মহিলা বাচ্চা বের করার চেষ্টা করছেন উনি একজন দাই মা। ঘাটে বোট ভিড়িয়ে মানুষজন নামিয়ে দিলাম ড্রাইভারকে রেখে। হাতের কাছে যা পাওয়া গেলো তা নিয়েই সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে শুরু করলাম। কাঁথা কাপড় দিয়েই নবজাতকের সেবা দিলাম, কর্ড ম্যানেজ করলাম, মায়ের ভাইটালস পরীক্ষা করতে করতে হিস্ট্রি নিলাম, অত্যাধিক ঝুঁকিপূর্ণ মা শনাক্ত করে হাসপাতাল থেকে রেফার করা হয়েছে। সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় মা একজন সুস্থ বাচ্চা প্রসব করলেন। যতটুকু পরীক্ষা করার সুযোগ ছিলো দ্রুত শেষ করে নিকটবর্তী হাসপাতালে পাঠালাম। আজ খুব বেশী উপলব্ধি করলাম বাংলাদেশের প্রতিটি দ্বীপ এলাকার মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে বিশেষ করে যেখানে রোগ নিয়ে ঘাট পারাপারের বিড়ম্বনা রয়েছে সেখানে প্রশিক্ষিত প্যারেমেডিক টীম সহ অন্তত একটি বা দুটি ওয়াটার এম্বুলেন্স এর সার্বক্ষণিক সার্ভিস জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজন।
উক্ত ফেসবুক পোস্টে তিনি আরো বলেন, “পরিশেষে বলি এই মহান চিকিৎসা পেশাকে আলিঙ্গন করতে পেরেছি, অলংকার বানাতে পেরেছি এ আমার পরম সৌভাগ্য, অপরিসীম প্রাপ্তি।অপরদিকে কঠিন দায়িত্ব। আমি সবসময়ই বিশ্বাস করি আমাদের ডাক্তারদের উপযুক্ত মনে করেছেন বলেই মানুষের চিকিৎসা করার মহান দায়িত্ব আমাদেরকে দিয়েছেন স্রষ্টা। সেই মহান দায়িত্ব যেনো যে কোন পরিস্থিতিতে আজীবন পালন করে যেতে পারি। সে টুকুই ফরিয়াদ….”