বঙ্গোপসাগরের কোলে জেগে ওঠা বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। দিগন্তজোড়া লোনা মাঠ, যেখানে প্রকৃতির আপন খেয়ালে জন্ম নেয় সাদা সোনা – লবণ। এই লবণ শুধু একটি অপরিহার্য খাদ্য উপাদান নয়, উপকূলীয় অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকার উৎস। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর প্রকৃতির কৃপণ দয়ার ওপর নির্ভর করে আমাদের পাতে লবণ আসে। অথচ, সেই লবণ উৎপাদনকারী চাষীদের জীবন আজ গভীর সংকটে নিমজ্জিত।
উপকূলের লোনা মাঠে জীবন বাজি রেখে যারা ফলায় সাদা সোনা, আজ তাদের মুখে হতাশার কালো মেঘ। প্রতি মণ লবণের উৎপাদন খরচ যেখানে আকাশছোঁয়া, সেখানে ন্যায্য দামের অভাবে তাদের স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ আর বাজার সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে প্রান্তিক চাষীরা তাদের শ্রমের সঠিক মূল্য পাচ্ছে না। পরিবার চালানো দায়, ঋণের বোঝা বাড়ছে প্রতিদিন। লোনা জলের সাথে মিশে যাচ্ছে তাদের চোখের জল।
প্রতি মণ লবণের দাম যেখানে মাত্র ১৫০ টাকা, সেখানে ৪০ শতক জমিতে ৩০০ মণ লবণ উৎপাদন করে একজন চাষীর মোট আয় হয় ৪৫,০০০ টাকা। কিন্তু এই সামান্য আয়ের বিপরীতে তাদের ব্যয় আকাশছোঁয়া। ৪০ শতক জমির মূল্য ৬০,০০০ টাকা, পলিথিন ও অন্যান্য সরঞ্জাম কিনতে খরচ হয় ২০,০০০ টাকা। মৌসুমজুড়ে শ্রমিকদের মজুরি বাবদ গুণতে হয় আরও ২০,০০০ টাকা। অর্থাৎ, প্রতি ৪০ শতক জমিতে লবণ উৎপাদন করতে একজন চাষীর মোট খরচ দাঁড়ায় ১,০০,০০০ টাকা।
সহজ হিসাব বলছে, ৪০ শতকে লবণ চাষ করে একজন চাষীর নিট ঘাটতি ৫৫,০০০ টাকা। উপরে দেওয়া হিসাবটি যেন উপকূলের প্রতিটি লবণ চাষীর বেদনার প্রতিচ্ছবি। এই বিপুল অঙ্কের লোকসান নিয়ে একজন প্রান্তিক চাষী কীভাবে টিকে থাকবে? দিনের পর দিন লোকসান গুনতে গুনতে তাদের স্বপ্নগুলো ফিকে হয়ে যাচ্ছে, জীবিকার একমাত্র অবলম্বনটুকু হারানোর ভয়ে তারা আতঙ্কিত।
লবণ চাষীদের এই দুরবস্থার মূলে রয়েছে ন্যায্য দামের অভাব। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, ফড়িয়াদের কারসাজি এবং বাজার সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে চাষীরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের শ্রমের ফসল চলে যাচ্ছে অন্যের পকেটে, আর তারা নিজেরা ঋণের জালে জর্জরিত হচ্ছে।
এমতাবস্থায়, উপকূলীয় লবণ চাষীদের দিকে একটু সহানুভূতিশীল দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। তাদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সময়ের দাবি। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বাজার তদারকি জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি বিদেশ থেকে লবণ আমদানির বিষয়ে ভারসাম্য আনয়ন করতে হবে। লবণ চাষে আধুনিক পদ্ধতি এবং সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়তা করতে হবে।
লবণ চাষীরা শুধু তাদের উৎপাদিত লবণের ন্যায্য দাম চায়। তারা চায় তাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন হোক। তারা চায় তাদের সন্তানরা খেয়ে-পরে বাঁচুক, শিক্ষার আলো দেখুক। লোনা জলের এই কান্না কি পৌঁছাবে নীতিনির্ধারকদের কানে? ন্যায্য দামের প্রতীক্ষায় থাকা লবণ চাষীদের দীর্ঘশ্বাস কি ঘুচবে? আসুন, আমরা সবাই মিলে তাদের পাশে দাঁড়াই, তাদের ন্যায্য অধিকারের জন্য সোচ্চার হই। কারণ, তাদের মুখের হাসিই আমাদের লবণের স্বাদ আরও বাড়িয়ে দেবে।
আলী ওসমান শেফায়েত
কুতুবদিয়া, কক্সবাজার।